আর্থ্রাইটিস বা বাতরোগের কারন, লক্ষন ও চিকিৎসা
আর্থ্রাইটিস বা বাতরোগ শরীরের একটি যন্ত্রণাদায়ক রোগ। শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের বাতের ব্যথা হয়ে থাকে। অস্থিসন্ধিতে ইউরিক এসিড জমা হয়ে এ রোগের উত্পত্তি হয়। মূত্রের মাধ্যমে যে পরিমাণ স্বাভাবিক ইউরিক এসিড বেরিয়ে যায়, তার থেকে বেশি পরিমাণ ইউরিক এসিড যখন আমাদের যকৃত তৈরি করে তখনই তা রক্তের পরিমাণ বাড়ায়। অথবা খাবারের মাধ্যমে বেশি পরিমাণ ইউরিক এসিডের উত্স যেমন লাল মাংস, ক্রিম, রেড ওয়াইন ইত্যাদি গ্রহণ করলে এবং বৃক্ক (কিডনি) রক্ত থেকে যথেষ্ট পরিমাণে তা ফিল্টার করতে না পারলে বাতের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। কিছু কিছু ওষুধ সেবনে রক্তে ইউরিক এসিডে এর মাত্রা বেড়ে যেতে পারে যেমন, থায়াজাইড, এসপিরিন, পাইরাজিনামাইড ইত্যাদি। তেমনি রেনাল ফেইলর, হাইপার প্যারাথাইরয়েডিজম এমন কিছু রোগেও ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
পুরুষদের এ রোগ হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। নারীদের তুলনায় পুরুষদের এই রোগ পাঁচ গুণ বেশি হয়ে থাকে। বাত সাধারণত কম বয়সী পুরুষ ও বেশি বয়সী নারীদের হয়ে থাকে। মেনোপোজ হওয়ার পর নারীদের মধ্যে এ রোগ দেখা দিতে পারে। যারা প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার, যেমন মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি বেশি খান, তাদের এই রোগ বেশি হয়।
বাতরোগের প্রকারভেদঃ
নিম্নোলিখিত রোগগুলোই সাধারণত একত্রিত হয়ে বাতরোগ গঠিত হয়ঃ
- সন্ধিবাত/ গাঁট – ফোলানো বাত (Rheumatoid Arthritis)
- অষ্টিওআর্থ্রাইটিস (Osteoarthritis)/অস্থিসংযোগ গ্রন্থি প্রদাহ
- গেঁটে বাত(Gout)
- কটিবাতবা কোমর প্রদাহ (Lumbago)
- মেরুদণ্ড প্রদাহ বা স্পন্ডিলাইটিস (Spondylitis)
- সায়াটিকা/কোটি স্নায়ুশূল(Sciatica)
- আম বাত/আর্টিকেরিয়া/অ্যালার্জি(Urticaria)
- বাতজ্বর(Rheumatic Fever)
- সংক্রামক বাত/সেপটিক আর্থ্রাইটিস
এছাড়াও ঘাড়ের বাত (Stiff Neck), স্কন্ধবাত (Omalgia), পার্শ্ববাত (Pleurodynia) এগুলোও বাত রোগের অন্তর্ভূক্ত হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
কয়েকটি পরিচিত বাতরোগ ও তাদের কারণ ও বিশেষ লক্ষণসমূহঃ
১) কটিবাত ও সায়াটিকা : কোমরের পেছনে রানের ব্যাথা হলে তাকে লুমবাগো বা কটিবাত বলে। আবার কোমরের নিচে সায়াটিকা নার্ভের প্রদাহ বলা হয়ে থাকে।
কটিবাত ও সায়াটিকা রোগের কারনঃ
- কটিদেশে সজোরে আঘাতপ্রাপ্ত হলে।
- ভারি বোঝা উঠালে বা বহন করলে।
- উচ্চ স্থান থেকে পড়ে নার্ভের উপর চাপ পড়লে।
- ভিটামিন বি এর অভাবে সায়েটিকা নার্ভে প্রদাহ হলে।
- তাছাড়া পুষ্টিকর খাবারের অভাব, শরীরে ঠান্ডা লাগা প্রভৃতি কারণে এই রোগ হয়ে থাকে।
চিত্রঃ কটিবাত বা সায়েটিকা
কটিবাত বা সায়টিকা রোগের লক্ষণসমূহ:
- কোমরে চাপ দিলে ব্যথা পাওয়া যায় না কিন্তু হাটলে বা নড়াচড়া করলে ব্যথা অনুভব হয়।
- কোমর নাড়ানো যায় না, বসে থেকে উঠতে গেলে ব্যথা অনুভব হয়।
- ভোরবেলা বা বর্ষা কালে স্যাত স্যাতে ঘরে থাকলে এই ব্যথা বৃদ্ধি পায়।
- ইলেকট্রিক শকের মত ব্যথা ও তীব্র যন্ত্র অনুভূত হয়।
২) পেশির বাতঃ শরীরের যেকোনো স্থানে পেশীর বাত রোগ হতে পারে। শরীরের সেই অংশে রক্ত চলাচল কম হলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। সুচিকিৎসা হলে এই ধরণের বাত রোগ ভালো হয়ে যায়।
পেশিবাতরোগের কারণঃ এই রোগের বিশেষ কোন কারন পাওয়া যায়না। এই রোগ সাধারণত ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স এর অভাবে হয়ে থাকে। এই বাত ব্যথার আরেকটি কারণ হতে পারে পানি শুন্যতা। পানির অভাবে রক্ত ‘ইলেক্ট্রোলাইট’য়ের ভারসাম্যে তারতম্য দেখা দেয়, ফলে বাত ব্যথা হয়। তাই রাতে বাতের ব্যথা দেখা দিলে বেশি করে পানি পান করতে পারেন ।
পেশিবাতরোগের লক্ষণসমূহ:
- হঠাৎ ঘুম থেকে উঠার পর রোগী মাংসপেশীর ব্যথা অনুভব করে।
- মাংসপেশী মনে হয় খিচে ধরে রাখে।
- আক্রান্ত স্থানে হাত দিলে মাংসপেশীর খিচুন বোঝা যায়।
৩) অ্যানকাইলোজিং স্পনডিলাইটিসঃ এটি একটি বিশেষ ধরণের বাত রোগ, যা মেরুদন্ডে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করে, মেরুদন্ডে বাঁক ধরে এবং মেরুদন্ড ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যায়, যার জন্য একে বলে অ্যানকাইলোজিং স্পনডিলাইটিস। অ্যানকাইলোজিং শব্দের অর্থ শক্ত এবং স্পনডিলাইটিস বলতে মেরুদন্ডের জ্বালা-পোড়া বা প্রদাহ বোঝায়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো এটি সাধারণ দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত রোগ, তবে এটি প্রধানত মেরুদন্ড ও কোমরের দুই দিকের অস্থিসন্ধিকে আক্রান্ত করে। এ রোগের বৈশিষ্ট্য হলো পিঠ ব্যথা ও শক্ত হয়ে যাওয়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হিপ এবং কাঁধ আক্রান্ত হতে পারে। খুব বিরল ক্ষেত্রে প্রান্তিক অস্থিসন্ধিগুলো আক্রান্ত হয়।
চিত্রঃ অ্যানকাইলোজিং স্পনডিলাইটিস
রোগের কারণ : এ রোগের সঠিক কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি, তবে বংশানুগতিক কারণের সঙ্গে এটি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এ রোগ বেশি দেখা দেয়। যারা এ রোগে আক্রান্ত হন তাদের প্রায় বেশিরভাগ রোগীই জেনেটিক মার্কার বা বংশগত নির্দেশক এইচএলএ-বি-২৭ বহন করেন।
অ্যানকাইলোজিং স্পনডিলাইটিস লক্ষণসমূহঃ রোগী সাধারণত সকালে পিঠ শক্ত হওয়া ও পিঠ ব্যথার অভিযোগ নিয়ে আসেন। ব্যথা শুরু হয় কোমরের দু’দিকের অস্থিসন্ধি বা স্যাক্রোইলিয়াক জয়েন্টে এবং ধীরে ধীরে তা সারা পিঠে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ব্যথা হিপজয়েন্ট (ঊরু অস্থিসংযোগ স্থল) ও নিতম্বে ছড়িয়ে পড়ে। রোগীর জ্বর হতে পারে এবং বুকের প্রসারণ কমে যেতে থাকে। অল্পবয়সী রোগীর বুকের প্রসারণ কমপক্ষে সাত সেন্টিমিটার এর মতো কমে যায়। ক্রমেই মেরুদন্ড শক্ত হয়ে পড়ে, মেরুদন্ডে বাঁক ধরতে শুরু করে। রোগী সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। অনেক রোগী সামনে ও উপরের দিকে তাকাতে পারেন না। আশপাশের কাউকে দেখতে হলে শরীরটাকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেখতে হয়। ধীরে ধীরে হিপজয়েন্ট, হাঁটু এমনকি কনুইও শক্ত হয়ে যায়। রোগীর হাঁটতে সমস্যা হয়।
বাত রোগের সাধারন লক্ষণ সমূহঃ
- হঠাৎ করে পায়ের গিড়ার জোড়া আক্রান্ত হয় এবং অত্যাধিক ব্যাথা হয়।
- অল্প অল্প জ্বর এই রোগের প্রধান লক্ষণ।
- ব্যথা কমে যাওয়ার পর আক্রান্ত স্থান ফুলে যায়।
- হাঁটুর জোঙা, পায়ের গোড়ালি, নখের জোড়া, হাতের কজ্বি, কনই প্রভৃতি স্থানে ব্যাথা হয়।
বাতরোগ এর জটিলতাঃ
- অস্টিওপোরেসিস।
- রিউমাটয়েড নোডিউল।
- শুষ্ক মুখ ও চোখ।
- ইনফেকশন।
- কার্পাল ট্যানেল সিনড্রোম।
- হৃৎপিন্ডের বিভিন্ন জটিলতা যেমন: হার্ট ব্লক।
- ফুসফুসের বিভিন্ন জটিলতা যেমন: ফুসফুসের প্রদাহ বা শ্বাসকষ্ট।
- লিম্ফোমাঃ রক্তের ক্যান্সার যা লসিকাগ্রন্থিকে আক্রান্ত করে।
- যাদের শরীর স্থুলকায় (Obesity) তাদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
বাতরোগ নির্ণয়ঃ
প্রথম অবস্থায়, বাতরোগ নির্ণয় করা কঠিন। এ অবস্থায় সাধারনত রোগীর লক্ষণ উপর ভিত্তি করে রোগ নির্ণয় করা হয়ে থাকে। এছাড়া নিম্নোক্ত কিছু পরীক্ষা করা হয়ে থাকেঃ
- ইলেক্ট্রোসাইট সেডিমেন্টেশন রেট (ESR)
- সি-রিয়্যাক্টিভ প্রোটিন (C-reactive Protein)
- অ্যানিমিয়া
- এক্সরে ও এম আর আই (MRI)
প্রতিরোধঃ
- পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে।
- শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে।
- সঠিক খ্যাদ্যাভাসঃ পর্যাপ্ত পরিমানে ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
- মানসিক দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে হবে।
বাতরোগের চিকিৎসাঃ
বাতরোগ দেখা দিলে বা বাতরোগে আক্রান্ত হলে ভাল চিকিৎসা নেয়া প্রয়োজন। সময়মত চিকিৎসা না নিলে নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং জটিল আকার ধারন করতে পারে। বাতরোগের অত্যন্ত ভাল ও উন্নতমানের হোমিও চিকিৎসা রয়েছে। রোগের বিবিধ লক্ষণ, রোগীর পীড়ার সাধারণ লক্ষণ, বিশেষ লক্ষণ, ধাতুজ লক্ষণ (Eonstitutional Symptoms), মানসিক লক্ষণ (Mental Symptoms) প্রভৃতির সাথে ঔষধের লক্ষণসমষ্টির সাদৃশ্যের ভিত্তিতে ঔষধ নির্বাচন করলে দ্রুত ও সমূলে রোগ আরোগ্য হয়। এক্ষেত্রে একজন উচ্চশিক্ষিত, অভিজ্ঞ ও সরকারি রেজিষ্টার্ড হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার এর পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
—————————————————————————————————————————-
ডাঃ মোঃ শফিকুল আলম
বি এইচ এম এস (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), এম ডি (এ এম), পি এইচ ডি (ভারত)
সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান- ফার্মেসী বিভাগ,
বিভাগীয় প্রধান, শিশু ওয়ার্ড,
সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিরপুর-১৪. ঢাকা-১২০৬।
যে কোন তথ্য ও পরামর্শের জন্যে- ০১৭১২-৭৯৬৫০৫।
Sorry, the comment form is closed at this time.